জ্বালানি তেলের উচ্চমূল্য বৃদ্ধি ও নানা সীমাবদ্ধতার কারণে গত দেড় দশক ধরে রাজধানীসহ সারাদেশে ব্যাপক হারে বেড়েছে সিএনজি চালিত যানবাহনের ব্যবহার। দামও ৭ টাকা ৪৫ পয়সা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৩ থেকে ৪৫ টাকায়। তবে দিন দিন গ্যাসের রিজার্ভ কমে আসায় সিএনজির প্রাপ্যতা নিয়ে তৈরি হয়েছে শঙ্কা। ফলে বিকল্প হিসেবে রান্নার কাজে ব্যবহৃত আমদানি জ্বালানি এলপিজির দিকেই এখন ঝুঁকছে মানুষ। এক পরিসংখ্যানে থেকে জানা গেছে, সারাদেশে সিএনজিচালিত যানবাহনের সংখ্যা প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ। তবে দামের দিক থেকে সিএনজি এবং মানের দিক থেকে তেলের সমতুল্য বিবেচিত হচ্ছে এখন এলপিজি। তাই তুলনামূলকভাবে খরচ কম হাওয়ায় এলপিজি কনভার্সনের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। অপরদিকে সিএনজি কনভার্সনের সংখ্যা দিন দিন কমছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজধানীসহ সারাদেশে বসুন্ধরা, বেক্সিমকো, যমুনা, নাভানা, ওমেরা, বিএম, পদ্মা সহ বেশ কয়েকটি কোম্পানির উদ্যোগে সারাদেশে চলছে এলপিজি ফিলিং স্টেশন তৈরির কাজ। চালু হওয়া প্রতিটি স্টেশনেই এলপিজি বিক্রি হচ্ছে ৫২ থেকে ৫৩ টাকায়।
রাজধানীর উত্তরার কামারপাড়া সংলগ্ন ইসলাম ব্রাদার্স এলপিজি ফিলিং স্টেশনে কর্মরত মুরাদ হোসেন জানান, এখন প্রায় সব জায়গাতেই সিএনজি পরিবর্তে এলপিজি ব্যবহার করা হচ্ছে। নিরাপত্তা, ব্যবহার যেটাই বলেন, সবদিক থেকেই এলপিজি এখন এগিয়ে।
ঐ স্টেশনেই নিজের ব্যবহৃত (প্রাইভেট কার)গাড়িতে এলপিজি নিতে আসা রবিউল আউয়াল নামের এক বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, সিএনজির তুলনায় এলপিজি-তে মাইলেজ বেশি পাওয়া যায়। এছাড়া এলপিজি ব্যবহার করার ফলে বারবার সিএনজি স্টেশনে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
উবার চালিত (প্রাইভেটকার) গাড়ি চালক ইকবাল মিয়া বলেন, এলপিজি-তে খরচ একটু বেশি হলেও গাড়ি নিয়ে সিরিয়ালে দাঁড়াতে হয় না। আগে দেখা যেত সিএনজি স্টেশনে গাড়ি নিয়া অনেক সময় আধা ঘণ্টা বা ১ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। কিন্তু এলপিজি ব্যবহারের ফলে সেই সময়টা আর লাগছে না।
এছাড়া সিএনজি গাড়ি চালাতে আর ভালো লাগেনা। চাকরি ছেড়ে অন্য জায়গায় গেলেও আর সিএনজি চালিত গাড়ি চালাবো না।
আগামী দুই, তিন বছরের মধ্যে এলপিজির মার্কেটটা যখন বাড়বে তখন দামও কিছুটা কমে আসবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ধারণা, আগামী দিনে যানবাহনের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারকারীদের পছন্দের শীর্ষে থাকবে এলপিজি।
জানতে চাইলে সাউদার্ন গ্রুপের চেয়ারম্যান মনোরঞ্জন ভক্ত বলেন, আমার এখানে সিএনজি কনভার্সন দিনে দিনে কমছে। গতমাসে সিএনজি কনভার্সন করেছি মাত্র ২৪ টি। কিন্তু এলপিজি কনভার্সন করেছি ৫২টি।
তিনি বলেন, যখন আমাদের সিএনজির পিক সিজন ছিলো, তখন প্রতি মাসে প্রায় ৭০০ থেকে ৮০০ গাড়ি কনভার্সন করেছি। সেখানে এখন মাসে মাত্র ২৪টা করছি। তার মানে আস্তে আস্তে সিএনজি কনভার্সন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে এলপিজিটা ধীরে ধীরে বাড়ছে।
সিএনজি ও এলপিজির দামের তারতম্য তুলে ধরে তিনি আরো বলেন, ৪৩ টাকায় সিএনজি, ৫২ থেকে ৫৩ টাকায় এলপিজি আর ৯৮ টাকায় অকটেন। এটা হল ফুয়েল কনজংশন কস্টিং কম্পারিজন। আমরা যদি তুলনা করি রান্নার ব্যবহৃত এলপিজি সঙ্গে, সেটা ৩৫-৩৬ টাকার বেশি হওয়ার কথা না। ৩৫-৩৬ টাকায় যদি এলপিজি আনা যায় তাহলে মানুষ আরো বেশি আগ্রহী হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ক্লিন ফুয়েল ফিলিং স্টেশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপক সারোয়ার আলম খন্দকার বলেন, ৬০ লিটার সিলিন্ডার দিয়ে হাতে যেটা টিউনিং করতে হয়, সেই এলপিজি কনভার্সন করতে আমরা ৩০ হাজার টাকায় নিচ্ছি। আর সিএনজি কনভার্সন করতে গেলে মিনিমাম ৫০ হাজার টাকা লাগবে।
আর ৬০ লিটার সিলিন্ডার দিয়ে সফটওয়্যারের মাধ্যমে যে এলপিজি কনভার্সন করছি সেটা ৫৫ থেকে ৬০ হাজার টাকা লাগবে। আর এদিকে সফটওয়ারে সিএনজি করতে গেলে ৭০ থেকে ৭৫ হাজার টাকা লাগবে। তাই এলপিজি নিরাপদ, সাশ্রয়ী এবং সব বিবেচনায় ব্যবহারকারীর জন্য সুবিধাজনক বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে বেক্সিমকো এলপিজি লিমিটেডের প্রধান বিপনন কর্মকর্তা মেহেদী হাসান ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, গত এক বছরে বাংলাদেশ অটো গ্যাসে মাইলফলক একটা পরিবর্তন নিয়ে আসছে।
তিনি বলেন, সিএনজি স্টেশন এভেলেবেল আছে দেশে প্রায় সাড়ে ৮০০। অথচ এই অল্প সময়ের মধ্যেই এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডার স্টেশন হয়েছে ৫০০ এর বেশি। এক বছর পর অর্থাৎ ২০২২ সালে ১২ থেকে ১৫০০তে উন্নত হবে। তো আপনি যদি গ্রাহকদের কথা চিন্তা করেন তাহলে এরা ভেলিডিটি ডেটে যাবে। যেকোনো জায়গায় তারা রিফিল করতে পারবে। এটা কাস্টমারকে বিশেষ পাওয়া বলে আমি মনে করি।
মেহেদী হাসান আরো বলেন, গত কয়েক বছর ধরে দাম বাড়ার ফলেও এলপিজির দাম যেখানে অটো গ্যাসের জন্য পার লিটার ৫৩ থেকে ৫৫ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো। যদি দাম কমে যায় আমার বিশ্বাস এটা আবার ৪০ টাকার নিচে চলে আসবে। সুতরাং কাস্টমারের কথা যদি আপনি চিন্তা করেন যেখানে অকটেনের দাম ৯৮ টাকা। যেটা এলপিজি অটো গ্যাসের তুলনায় ডাবল এর চেয়ে বেশি। সে ক্ষেত্রে এই সেক্টরে ব্যাপক একটা সুবিধা পাচ্ছে গ্রাহকরা। এছাড়া আপনি জানেন যে, অটো গ্যাসে মাইলেজ বেশি পাওয়া যায়। গাড়ির পার্টসগুলোও ভালো থাকে। তুলনা করলে অকটেনের মতোই সার্ভিস দেয়।
সিএনজির যে সমস্যাগুলো হয় গাড়িতে এলপিজিতে সে সমস্যাগুলো হয় না। অধিক তাপ হয় না, ওজন কম। এর ফলে ঝুঁকিমুক্ত থাকে গাড়ি। এটা একটা বড় ব্যাপার।
এই মুহূর্তে এলপিজি মার্কেটটা যেভাবে সম্ভাবনাময় হয়ে উঠেছে, সরকারের উচিত এগিয়ে আসা এবং মানুষকে এই বিষয়ে সচেতন করা বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ডেইলি বাংলাদেশ/আরএইচ